আয়কর গণনা ও রিটার্ন তৈরির জন্য দরকারি কাগজপত্র | Professionals TaxVAT
আয়কর গণনার কাজ শুরু হয় আপনার সারাবছর বিভিন্ন উৎস থেকে যে আয় হয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে এবং এই আয় করতে গিয়ে কিছু কিছু সময় হয়তো উৎসে আপনার কাছ থেকে কর কর্তন করে রেখেছে। আবার আপনি যে আয় করেছেন তা থেকে সংসার খরচ করে যে টাকা আপনার কাছে ছিল তা হয়তো কিছু বিনিয়োগ করেছেন। এই যাবতীয় তথ্যই আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে।
আয়কর গণনার সময় আপনার হাতের কাছে এসব দরকারি কাগজপত্র রাখতে হবে, যা দেখে দেখে প্রথমে কর গণনা এবং পরে রিটার্ন তৈরি করতে পারবেন এবং সবশেষে যখন আপনি রিটার্ন দাখিল করবেন তখন রিটার্নের সঙ্গেও প্রমাণ হিসেবে ট্যাক্স অফিসে কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হবে। আয়কর গণনা ও রিটার্ন তৈরি করতে কী কী কাগজ লাগবে এবং এই কাগজগুলো আপনি কোথা থেকে সংগ্রহ করবেন তা নিচে থেকে একে একে জেনে নিন।
বেতন বিবরণী এবং ব্যাংক বিবরণী
চাকরিজীবী করদাতাকে তার কোম্পানি থেকে বেতন বিবরণী সংগ্রহ করতে হবে। সারাবছর ধরে মূল বেতন, বাড়িভাড়া ভাতা, যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বোনাসসহ মোট কত টাকা পেয়েছেন এবং তার ওপর কত টাকা উৎসে কর কর্তন হয়েছে – এই তথ্য উল্লেখ করে বেতন বিবরণী নিতে হবে।
জুন মাস শেষ হওয়ার পর আপনি হিসাব বিভাগ বা মানবসম্পদ বিভাগ, যেখান থেকে বেতন বিবরণী দেয়া হয়ে থাকে, সেখানে যোগাযোগ করে আপনার বেতন বিবরণী সংগ্রহ করতে পারেন ।
এর সঙ্গে লাগবে আপনার যে ব্যাংক হিসাবে প্রতিমাসে কোম্পানি থেকে বেতন ট্রান্সফার হয় তার জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত সারা অর্থবছরের ব্যাংক বিবরণী। জুন ২০২৩ যেহেতু শেষ হয়ে গেছে, তাই আপনি যে কোনো সময় ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করতে পারেন।
বাড়িভাড়ার চুক্তিনামা, ভাড়ার রসিদ এবং ব্যাংক বিবরণী
যেসব করদাতার আয় বাড়িভাড়া থেকে আসে তাদের ভাড়াটিয়ার সঙ্গে যে চুক্তিনামা (যদি থাকে) সম্পাদন হয়েছে তার কপি রিটার্নের সঙ্গে জমা দিতে হবে। যেহেতু এই কপি আপনার কাছে আছে তাই আর কারো কাছে যেতে হবে না। রিটার্ন জমা দেয়ার আগে ফটোকপি করে সঙ্গে জমা দেবেন। তাছাড়া প্রতিমাসে ভাড়া নেয়ার সময় ভাড়াটিয়াকে যে রসিদ দেয়া হয় তার কপিও রাখতে হবে।
বাড়িভাড়া মাসে পঁচিশ হাজার টাকার সমান বা এর বেশি হলে যাবতীয় বাড়িভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করতে হয়। তাই সারাবছর ধরে অর্থাৎ জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত আপনি বাড়িভাড়া থেকে কত আয় করেছেন তা জানার জন্য সারাবছরের ব্যাংক বিবরণী ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করুন ।
বাড়ি তৈরি/ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের বিবরণী
বাড়ি তৈরি করার সময় বা ফ্ল্যাট কেনার সময় যদি ঋণ নিয়ে থাকেন তাহলে সেই ব্যাংক ঋণের বিবরণী ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করুন। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার সময় সঙ্গে সুদও পরিশোধ করতে হয়। সেই সুদ বাড়িভাড়া আয় থেকে বাদ গিয়ে করযোগ্য আয় নির্ণয় করা হয়। তাই সারাবছর ধরে কত সুদ দিয়েছেন এবং মূল ঋণ কত পরিশোধ করেছেন, লোন স্টেটমেন্ট দেখে নিশ্চিত হয়ে নিন ।
ভূমি রাজস্ব, পৌর কর, সিটি করপোরেশন কর, অন্যান্য বিল
বাড়ি/ফ্ল্যাটের মালিককে কর বাবদ সরকারকে ভূমি রাজস্ব দিতে হয় ৷ এছাড়া পৌর কর, সিটি করপোরেশন কর, ওয়াসার বিল, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদিও পরিশোধ করতে হয় । এসব খরচ বাড়িভাড়া আয় থেকে বাদ গিয়ে করযোগ্য আয় বের করা হয় । তাই এই খরচগুলোর প্রমাণ হিসেবে বিল জমা দেয়ার কপির ফটোকপি করে রাখুন ।
স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়/বিক্রয়/হস্তান্তর
স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়/বিক্রয়/ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিলের কপির ফটোকপি করে রাখুন ।
অন্যান্য উৎসের আয়
আয়কর রিটার্নে মোট দশটি খাত রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো অন্যান্য উৎস হতে আয়। বাকি নয়টি খাতের বাইরে যে আয়গুলো রয়েছে সেগুলো এই খাতে দেখাতে হয়। যেমন, ব্যাংক জমার ওপর সুদ। ব্যাংক সুদের ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের বিবরণী ইত্যাদি যেখানে যেখানে আপনি করেছেন সেখান থেকে সংগ্রহ করে রাখুন ।
আয়কর পরিশোধের প্রমাণাদি
আপনি যে আয় করেছেন সেসব আয় পরিশোধের সময় উৎসে যদি কর কর্তন প্রযোজ্য হয় তাহলে আপনার আয় থেকে নির্ধারিত কর কর্তন করে আপনাকে পরিশোধ করেছে। যেমন, আপনি যদি চাকরিজীবী হয়ে থাকেন তাহলে মাসশেষে বেতন থেকে আনুমানিক একটি অংক কর হিসেবে কেটে রেখে আপনার ব্যাংক হিসেবে বেতন ট্রান্সফার করেছে।
যেহেতু আপনি আয়ের ওপর উৎসে কিছুটা কর আগেই দিয়ে দিয়েছেন, তাই বছরশেষে যখন আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন তখন মোট করদায় থেকে আগে পরিশোধ করা কর বাদ দিয়ে বাকি যেটা থাকবে সেটাই হবে আপনার প্রকৃত করদায়।
এখন এই কর বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে যেটা আপনি দাবি করছেন যে পূর্বে পরিশোধ করেছেন, তার প্রমাণ হিসেবে চালানের কপি দাখিল করতে হবে। চালানের কপি প্রমাণ হিসেবে দিতে না পারলে আপনি এই উৎসে কর্তনকৃত কর দাবি করতে পারবেন না । তাই যেখানে যেখানে আপনার আয় হয়েছে এবং সেখান থেকে যদি আপনার কাছ থেকে কর কেটে রাখা হয়, তাহলে তাদের কাছ থেকে আপনি চালানের কপি সংগ্রহ করে রাখুন।
বিনিয়োগজনিত প্রমাণাদি
আপনি যদি বিনিয়োগ করে থাকেন যেমন, শেয়ার ক্রয়, সঞ্চয়পত্র ক্রয়, ডিপিএস, জীবন বীমা প্রিমিয়াম, স্বীকৃত জাকাত তহবিলে দান ইত্যাদি, সেক্ষেত্রে উল্লিখিত বিনিয়োগ বা অনুদানের প্রমাণাদি সংগ্রহ করুন।
আয়কর গণনার সঙ্গে বিনিয়োগ ভাতা সম্পর্কে জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিনিয়োগ ভাতার ওপরই কর রেয়াত পাওয়া যায়, যা করদায় বহুলাংশে হ্রাস করে থাকে ।
মোহাম্মদ আদনান
আয়কর আইনজীবী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড