চিকিৎসকের আয় কি করযোগ্য? | Professionals TaxVAT
চিকিৎসক চাকরির পাশাপাশি যদি প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে আয় করেন তাহলে বেতন খাতে যে আয় হয়েছে তার সঙ্গে রোগী দেখার আয় যোগ করে সম্পূর্ণ আয়ের ওপর কর দিতে হবে।
আপনি যদি চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করেন তাহলে আপনার চাকরি করে যে আয় হয়েছে তা থেকে অব্যাহতি প্রথমে বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় বের করতে হবে। তবে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করে বেতন থেকে করযোগ্য আয় বের করার নিয়ম সম্পূর্ণ আলাদা, যা আগেই আলোচনা করেছি। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে করের আওতা অনেক কম। এজন্য তাদের আয়কর গণনা করাও অনেকটা সহজ।
আপনি যদি বেসরকারি কোনো হাসপাতালে চাকরি করেন তাহলে ‘বেসরকারি চাকরিজীবী করদাতার করদায় গণনা’ দেখে নিন। করযোগ্য আয় পর্যন্ত করে এবার এই লেখাটি থেকে শুরু করুন। অর্থাৎ, করযোগ্য আয় গণনার পর বিনিয়োগ ভাতা, কর রেয়াত গণনা এবং করদায় গণনা করার দরকার নেই। কারণ, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে যে আয় বের হবে তা যোগ করে একত্রে করদায় বের করব।
আর আপনি যদি শুধু সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালেই চাকরি করেন এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী না দেখেন, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ,
আপনি চাকরি করে যে আয় করেছেন তা সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক, তা আপনি আগের পোস্ট থেকে জেনে গেছেন।
তবে কেউ যদি শুধু প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে জীবিকা চালিয়ে থাকেন তাহলে আপনার জন্য এই লেখাটি প্রযোজ্য। চলুন একটি উদাহরণ ব্যবহার করে ধাপে ধাপে করযোগ্য আয়, বিনিয়োগ ভাতা, কর রেয়াত এবং করদায় নির্ণয় করি।
মিস্টার ক্লিন্টন শর্মা সরকারি হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখেন। প্রতিদিন ২০ জন নতুন রোগী এবং ৫ জন পুরনো রোগী দেখেন । নতুন রোগীর ফি ৮০০ টাকা এবং পুরনো রোগীর ফি ৪০০ টাকা। তিনি বছরে ২৫০ দিন রোগী দেখেন। তিনি রোগীর জন্য রেজিস্টার রাখলেও খরচের জন্য কোনো খাতাপত্র সংরক্ষণ করেন না।
সারাবছরে তিনি জীবন বীমা প্রিমিয়াম দিয়েছেন ২,০০,০০০ টাকা, নতুন করে শেয়ার কিনেছেন ২,৫০,০০০ টাকা এবং ডিপিএস করেছেন ৬০,০০০ টাকা ।
তাহলে জেনে গেলাম মিস্টার ক্লিন্টন শর্মার যাবতীয় তথ্য। এবার একে একে করযোগ্য আয়, বিনিয়োগ ভাতা, কর রেয়াত এবং করদায় গণনা করব।
করযোগ্য আয় গণনা
ওপরে মিস্টার ক্লিন্টন শর্মার যে উদাহরণ দিয়েছি সেখানে কিছু তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে উল্লেখ রয়েছে। যেহেতু সারাবছরের আয় হিসাব করছি তাই আয়গুলোকে বাৎসরিক করে নেব।
সরাসরি নিচের টেবিলে মিস্টার ক্লিন্টন শর্মার প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে যে আয় হয়েছে তা থেকে খরচ বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় বের করব।
| ক্র. নং | বিবরণ | টাকা |
| ০১ | প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে আয়
(২০*৮০০+৫*৪০০)*২৫০ |
৪৫,০০,০০০ |
| ০২ | আনুমানিক ভিত্তিতে খরচ
(আয়ের ১/৩ অংশ- ৪৫,০০,০০০*১/৩) |
(১৫,০০,০০০) |
| প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে আয় | ৩০,০০,০০০ | |
| চাকরি করে বেতন খাতে আয় | ৪,৯৭,০০০ | |
| মোট করযোগ্য আয় | ৩৪,৯৭,০০০ | |
উপরের টেবিলে মিস্টার শর্মার প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে আয় এবং বেতন খাতে মোট করযোগ্য আয় মিলে মোট করযোগ্য আয় ৩৪,৯৭,০০০ টাকা পেয়ে গেছি। আপনার মনে হয়তো এখন কয়েকটি প্রশ্ন এসে জড়ো হয়েছে।
এক, রোগী দেখে ৪৫ লাখ টাকা আয় হয়েছে তা থেকে কেন এক-তৃতীয়াংশ বাদ দিলাম। আপনি যদি খরচের হিসাবপত্র না রাখেন তাহলে আপনার রোগী দেখে সারাবছর যে আয় হয়েছে তা থেকে তিন ভাগের এক ভাগ বাদ দিতে পারবেন । এটা আয়কর কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েই আপনার আয়কর ধার্য করবে।
তবে আয়কর আইনে একজন চিকিৎসক রোগী দেখার জন্য যে আয় হয় এবং এর সঙ্গে যে খরচ হয় তার জন্য কীভাবে রেজিস্টার রাখতে হবে তার ছক/টেবিল দেয়া আছে। আপনি ওই পদ্ধতি মেনে হিসাব রাখতে পারেন। তাহলে আপনার প্রকৃতপক্ষে যে খরচ হবে আপনি তা বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় বের করতে পারবেন ।
মিস্টার ক্লিন্টন শর্মা যেহেতু সরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন তাই তার বেতন খাতে যে ৪,৯৭,০০০ টাকা আয় হয়েছে তা এখানে নিয়ে এসেছি। আর আপনি যদি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন তাহলে ‘বেসরকারি চাকরিজীবী করদাতার করদায় গণনা’তে যেভাবে করযোগ্য আয় ১৪,৩৬,০০০ টাকা বের করেছি ওইভাবে বের করে ৩০ লাখ টাকার সঙ্গে যোগ করবেন। এভাবে যোগ করলেই আপনি আপনার মোট করযোগ্য আয় পেয়ে যাবেন।
আশা করছি, আপনি আপনার করযোগ্য আয় পেয়ে গেছেন।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ওপরে দুটি খাত থেকে করযোগ্য আয় নির্ণয় করেছি। একটি হলো বেতন খাত এবং অন্যটি প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে আয় । বেতন খাত থেকে যে করযোগ্য আয় হয়েছে তা আয়কর রিটার্নের বেতন খাতের ঘরে লিখব। আর প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে যে আয় হয়েছে তা ব্যবসা বা পেশা খাতের ঘরে লিখব।
যেহেতু করযোগ্য আয় পেয়ে গেছি তাই এবার বিনিয়োগ ভাতা বের করে কর রেয়াত নির্ণয় করব।
বিনিয়োগ ভাতা এবং কর রেয়াত
আগে জেনেছিলাম, করযোগ্য আয়ের ৩% কর রেয়াত হিসেবে দাবি করা যায়। তাহলে মিস্টার শর্মার করযোগ্য আয় ৩৪,৯৭,০০০ টাকার ৩% হিসেবে কর রেয়াত হবে ১,০৪,৯১০ টাকা।
এবার দেখতে হবে তিনি প্রকৃতপক্ষে কত বিনিয়োগ করেছেন এবং তার উপর তিনি কত টাকা কর রেয়াত পাবেন। চলুন তার প্রকৃত বিনিয়োগ দেখে নিই।
| ক্র. নং | বিনিয়োগ খাত | টাকা |
| ০১ | ভবিষ্য তহবিল (৩,৫০০x১২) | ৪২,০০০ |
| ০২ | ডিপিএস (৫,০০০×১২) | ৬০,০০০ |
| ০৩ | জীবন বীমা প্রিমিয়াম | ৩,৪০,০০০ |
| ০৪ | শেয়ার ক্রয় | ৪,৫০,০০০ |
| মোট প্রকৃত বিনিয়োগ | ৮,৯২,০০০ | |
উপরের টেবিল থেকে দেখতে পাচ্ছি মিস্টার ক্লিন্টন শর্মা বিনিয়োগ করেছেন ৮,৯২,000 টাকা। এই টাকার উপর ১৫% হিসেবে কর রেয়াত আসে ১,৩৩,৮০০ টাকা। কিন্তু তিনি ১,০৪,৯১০ টাকা কর রেয়াত হিসেবে দাবী করতে পারবেন।
আপনার মনে হয়তো একটি প্রশ্ন এসেছে, ভবিষ্য তহবিল কেন ৩,৫০০ টাকা নিয়ে আসলাম এবং কেন আবার ১২ দিয়ে গুণ করলাম?
এর কারণ হলো, মিস্টার শর্মা যেহেতু চাকরি করেন এবং সেখানে তার বেতন থেকে প্রতিমাসে ভবিষ্য তহবিলে ৩,৫০০ টাকা করে কেটে রাখে তাই এই টাকা বিনিয়োগের সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আর ১২ দিয়ে গুণ করে সারাবছরে তিনি ভবিষ্য তহবিলে কত কন্ট্রিবিউট করেছেন তা বের করে নিলাম।
আপনি যখন আপনার নিজের প্রকৃত বিনিয়োগ বের করবেন তখন যে যে খাতে আপনি বিনিয়োগ করেছেন তা একসঙ্গে এনে যোগ করলেই হবে।
এবার মিস্টার শর্মার করদায় নিচের টেবিলে গণনা করে দেখাব।
| করযোগ্য আয় | করহার | করদায় (টাকা) |
| প্রথম ৩,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ০% | – |
| পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ৫% | ৫,০০০ |
| পরবর্তী ৩,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ১০% | ৩০,০০০ |
| পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ১৫% | ৬০,০০০ |
| পরবর্তী ৫,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ২০% | ১,০০,০০০ |
| অবশিষ্ট ১৮,৪৭,০০০ টাকা পর্যন্ত | ২৫% | ৪,৬১,৭৫০ |
| মোট করদায় | ৬,৫৬,৭৫০ | |
| বাদ : কর রেয়াত | ১,০৪,৯১০ | |
| নিট করদায় | ৫,৫১,৮৪০ | |
| উৎসে কর কর্তন (২,০০০x১২) | (২৪,০০০) | |
| অগ্রীম কর | (৫,০০,০০০) | |
| রিটার্নের সঙ্গে প্রদত্ত কর | ২৭,৮৪০ | |
তাহলে পেয়ে গেলাম মিস্টার ক্লিন্টন শর্মার নিট করদায় ৫,৫১,৮৪০ । এখানে আপনার প্রশ্ন আসতে পারে, উৎসে কর কর্তন এবং অগ্রিম করের পরিমাণ কোথায় পেয়েছি?এটা ধরে নিয়ে আপনাকে দেখিয়েছি যাতে করে আপনি নিজেও আপনার কাছ থেকে উৎসে কর কর্তন এবং অগ্রিম কর পরিশোধ করে থাকলে এভাবে বাদ দিতে পারেন। উৎসে কর কর্তন ও অগ্রিম কর বাদ দেয়ার পর যে অবশিষ্ট করদায় থাকে তা রিটার্ন জমা দেয়ার সময় চালান করে জমা দিতে পারবেন ।
আপনি জানলেন একজন চিকিৎসক চাকরির পাশাপাশি যদি প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে আয় করেন তাহলে কীভাবে করযোগ্য আয় বের করে করদায় গণনা করবেন এবং এই প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে যে আয় হয়েছে তা ব্যবসা বা পেশা খাতে দেখাতে হবে, যা আগে উল্লেখ করেছি।
তবে চাকরি বা অন্য যে কোনো পেশায়ই থাকি না কেন, পাশাপাশি আমরা বাড়তি উপার্জনের জন্য কিছু কাজ করে থাকি। আবার আমরা যে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করি তা থেকে কিছু আয়ও আমাদের প্রতিবছর হয়ে থাকে। এই অন্যান্য খাতের আয়ের ওপরও আয়কর দিতে হয়। এই নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করবো।
Bangladesh Professionals VAT and Tax Law Firm