বাড়িওয়ালার আয় কত হলে ট্যাক্স দিবেন | Professionals TaxVAT
বাড়িভাড়া দিয়ে যদি আয় হয় তাহলে সে আয় থেকে বাড়ি মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচসহ অন্যান্য আরো অনুমোদিত খরচ বাদ দিয়ে যে করযোগ্য আয় আছে তার ওপর কর দিতে হয়। কেউ পৈতৃক সূত্রে, আবার কেউ নিজে প্লট কিনে বাড়ি তৈরি করে ফ্ল্যাট বা বাসা বাড়া দিয়ে থাকেন। আবার, যারা চাকরি করেন বা ব্যবসা করেন তারা একটি বা দুটি ফ্ল্যাট কিনেও ভাড়া দিয়ে থাকেন।
এখন আপনি যেভাবে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হন না কেন, আপনার করযোগ্য আয় যদি করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করে তাহলে আপনাকে অবশ্যই রিটার্ন দাখিল করতে হবে এবং কর দিতে হবে। তাহলে আপনি কীভাবে বাড়িভাড়া আয় থেকে করযোগ্য আয় এবং করদায় গণনা করবেন তা চলুন একটি উদাহরণ ব্যবহার করে জেনে নিই।
মিজ নন্দিনী সারোয়ারের ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় চারতলা বাড়ি আছে। প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট আছে। প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে তিনি মাসে ২৫,০০০ টাকা করে ভাড়া পান। ভাড়া দেয়ার সময় তিনি এক মাসের ভাড়া অগ্রিম নিয়ে থাকেন। বছরশেষে তার নিচের খরচগুলো হয়েছে :
০১. বাড়ি মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৬,৫০,০০০ টাকা
০২. সিটি করপোরেশন কর ২০,০০০ টাকা
০৩. বাড়ি বীমা করার জন্য প্রিমিয়াম ২৫,০০০ টাকা
০৪. বাড়ি তৈরি করার সময় লোন নিয়েছিলেন যার জন্য বছরে সুদ দিয়েছেন ১,০০,০০০ টাকা
ওপরের খরচ এবং সংসার খরচ চালানোর পর তার কাছে যে অবশিষ্ট টাকা থাকে তা তিনি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে থাকেন। এর মধ্যে তিনি শেয়ার কিনেছেন ৩,৫০,০০০ টাকার, নিজ নামে ডিপিএস করেছেন মাসিক ৫,০০০ টাকার এবং বছরে জীবন বীমা প্রিমিয়াম দিয়েছেন ৫০,০০০ টাকা।
একে একে জেনে নিলাম মিজ নন্দিনী সারোয়ারের বাড়ি থেকে আয় এবং ব্যয়ের তথ্য । পাশাপাশি তিনি সারাবছর ধরে যে বিনিয়োগ করেছেন সেসব তথ্য। এবার ধাপে ধাপে তার করযোগ্য আয়, কর রেয়াত এবং করদায় নির্ণয় করব।
মোট করযোগ্য আয়
বাড়িভাড়া থেকে আয় গণনার সময় যে মাসিক ভাড়ার কথা উদাহরণে উল্লেখ করেছি তা হলো, আপনি প্রকৃতপক্ষে ভাড়া দিয়ে যা পাচ্ছেন । কিন্তু প্রতিটি এলাকায় সিটি করপোরেশন কর্তৃক এলাকা অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। এখন যদি দেখা যায়, আপনি যে ভাড়া দিচ্ছেন বা বলছেন, তা যদি নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম হয় তাহলে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ভাড়াই হবে আপনার আয় । কিন্তু আপনার দেয়া ভাড়া যদি আবার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি হয় তাহলে আবার আপনারটাই হবে ভাড়া থেকে আয় ।
আপনার বাড়ি ভাড়া থেকে আয়ের পর সারাবছর ধরে বাড়ি মেরামত এবং আনুষঙ্গিক আরো অনেক কাজ করতে হয়। এর জন্য যে খরচ হয় তার সব খরচ আপনি বাড়িভাড়া আয় থেকে বাদ দিতে পারবেন না । বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য যদি ঋণ নিয়ে থাকেন তাহলে সেই ঋণের ওপর যে সুদ দেবেন তা বাড়িভাড়া আয় থেকে বাদ দিতে পারবেন। আবার বাড়ির জন্য যদি বীমা করেন এবং তার জন্য যে প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন, বিভিন্ন ধরনের কর বা খাজনা ইত্যাদি আপনি খরচ দেখিয়ে বাড়িভাড়া আয় থেকে বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় বের করতে পারবেন; যার ওপর আপনাকে কর দিতে হবে।
আপনি বাড়িভাড়া দিয়ে যে আয় এবং ব্যয়ের কথা বলছেন তার জন্য আপনাকে আয়কর আইন অনুযায়ী কিছু নিয়ম পালন করতে হবে। যেমন, বাড়ি ভাড়া দিয়ে মাসে যদি ২৫,০০০ টাকার বেশি ভাড়া আসে তাহলে আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে, যেখানে আপনি মাসশেষে ভাড়া পাওয়ার পর জমা রাখবেন। বাড়ির মালিক যদি এই নিয়ম পালন না করেন তাহলে তিনি বাড়িভাড়া দিয়ে যে আয় করেছেন তার উপর যে কর আসবে তার ৫০% অথবা ৫,০০০ টাকা; এই দুইটা অংকের মধ্যে যেটা বড় হবে তা উপকর কমিশনার জরিমানা করতে পারেন। তাই উপরিউক্ত নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করুন।
আবার আপনি যে বাড়ি মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ দাবি করছেন তার জন্য যথাযথ খরচের বিল থাকতে হবে। কেউ যদি তা রাখেন তাহলে আবাসিক ভাড়ার ক্ষেত্রে আয়ের ২৫% বা বাণিজ্যিক ভাড়ার ক্ষেত্রে ৩০% বাদ দেয়া যায়। কিন্তু আপনি যদি খরচের বিল/ভাউচার না রাখেন তাহলে আয়কর কর্তৃপক্ষ বাদ দিয়ে দিতে পারেন। তখন আপনার করযোগ্য আয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে। যার ফলে আপনার আয়করের পরিমাণও বেড়ে যাবে। তাই সব খরচের বিল/ভাউচার রেখে দেয়া ভালো।
বিস্তারিত আলোচনার পর এবার চলুন উদাহরণ থেকে করযোগ্য আয় নির্ণয় করি। ওপরে মিজ নন্দিনী সারোয়ারের যে উদাহরণ দিয়েছি সেখানে মাসিক ভিত্তিতে তিনি কত ভাড়া পান তা উল্লেখ রয়েছে। এর সঙ্গে কিছু তথ্য রয়েছে বাৎসরিক ভিত্তিতে। যেহেতু সারাবছরের আয় হিসাব করছি তাই যে তথ্যগুলো মাসিক রয়েছে তাকে ১২ মাস দিয়ে গুণ করে বাৎসরিক করে নেব।
ক্র. নং | বিবরণ | টাকা |
০১ | বাড়িভাড়া থেকে আয় (২৫,০০০×২×৪x১২) | ২৪,০০,০০০ |
০২ | মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ (২৪,০০,০০০ × ২৫%) | (৬,০০,০০০) |
০৩ | সিটি করপোরেশন কর | (২০,০০০) |
০৪ | বাড়ি বীমা করার জন্য প্রিমিয়াম প্রদান | (২৫,০০০) |
০৫ | গৃহ ঋণের সুদ পরিশোধ | (১,০০,০০০) |
বাড়িভাড়া থেকে করযোগ্য আয় | ১৬,৫৫,০০০ |
ওপরের টেবিলে খুব সহজে মিজ নন্দিনী সারোয়ারের বাড়িভাড়া আয় থেকে খরচ বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় ১৬,৫৫,০০০ টাকা পেয়ে গেছি। আশা করছি, আপনিও আপনার করযোগ্য আয় পেয়ে গেছেন ।
ওপরের টেবিল থেকে হয়তো আপনার মনে কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছে। প্রথমে প্রতিটি ফ্ল্যাট ভাড়া ২৫,০০০ টাকাকে দুই দিয়ে গুণ করেছি এবং তারপর আবার চার দিয়ে গুণ করেছি। এর কারণ হলো, প্রতিটি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট আছে তাই দুই দিয়ে গুণ করেছি। আর যেহেতু বাড়িটি চারতলা তাই চার দিয়ে গুণ করেছি। বারো দিয়ে গুণ করে আমরা সারাবছরের বাড়ি ভাড়া থেকে আয় বের করে নিলাম। আপনিও এভাবে সাদা কাগজে হিসাব করে নিতে পারেন ।
তবে আপনি যদি বাড়িভাড়ার হিসাব রাখার জন্য রেজিস্টার রাখেন তাহলে সেখান থেকে দেখে সরাসরি লিখে নিতে পারেন। আর যাদের একটি ফ্ল্যাট তারা ভাড়াকে বারো মাস দিয়ে গুণ করলেই সারাবছরের আয় বের হয়ে যাবে। আর খরচের মধ্যে মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মিজ নন্দিনী সারোয়ার খরচ করেছেন ৬,৫০,০০০ টাকা । কিন্তু আয়কর আইন অনুযায়ী তিনি সর্বোচ্চ ২৫% তার বাড়িভাড়া আয় ২৪,০০,০০০ টাকা থেকে বাদ দিতে পারবেন, যা হলো ৬,০০,০০০ টাকা ।
কিছু সময় দেখা যায় যে, বাড়িভাড়া দিয়ে আয় হচ্ছে সেই একই বাড়িতে বাড়ির মালিকও থাকছেন। সেক্ষেত্রে আয়ের আনুপাতিক হারে খরচ বাদ দিতে হবে। যেমন, মিজ নন্দিনী সারোয়ারের মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা আটটি। তিনি যদি দুটি ফ্ল্যাটে নিজে থাকেন তাহলে ভাড়া পাচ্ছেন তিনি বাকি ছয়টি ফ্ল্যাট থেকে, যার ওপর তিনি আয়কর দিচ্ছেন। তাই প্রতিটি খরচকে ৮ দিয়ে ভাগ করে ৬ দিয়ে গুণ করে যা আসবে তা বাড়িভাড়া আয় থেকে বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় বের করবেন।
যেহেতু করযোগ্য আয় পেয়ে গেছি তাই এবার বিনিয়োগ ভাতা বের করে কর রেয়াত নির্ণয় করব।
বিনিয়োগ ভাতা এবং কর রেয়াত
করযোগ্য আয়ের ৩% কর রেয়াত হিসেবে দাবি করা যায়। তাহলে মিজ নন্দিনী সারোয়ারের করযোগ্য আয় ১৬,৫৫,০০০ টাকার ৩% হিসেবে কর রেয়াত হবে ৪৯,৬৫০ টাকা। মিজ নন্দিনী সারোয়ারের কর রেয়াত পেয়ে গেলাম। এবার দেখতে হবে তিনি প্রকৃতপক্ষে কত বিনিয়োগ করেছেন এবং তার উপর তিনি কর রেয়াত কতো পাবেন । চলুন তার প্রকৃত বিনিয়োগ দেখে নিই।
ক্র. নং | বিনিয়োগ খাত | টাকা |
০১ | শেয়ার ক্রয় | ৩,৫০,০০০ |
০২ | ডিপিএস (৫,০০০×১২) | ৬০,০০০ |
০৩ | জীবন বীমা প্রিমিয়াম | ৫০,০০০ |
মোট প্রকৃত বিনিয়োগ | ৪,৬০,০০০ |
ওপরের টেবিল থেকে দেখতে পাচ্ছি মিজ নন্দিনী সারোয়ার বিনিয়োগ করেছেন ৪,৬০,০০০ টাকা। এই টাকার উপর ১৫% হিসেবে কর রেয়াত আসে ৬৯,০০০ টাকা। কিন্তু তিনি কর রেয়াত দাবী করতে পারবেন ৪৯,৬৫০ টাকা। যদিও তিনি বেশি বিনিয়োগ করেছেন কিন্তু তিনি ৪৯,৬৫০ টাকাই কর রেয়াত সুবিধা পাবেন ।
আপনার বিনিয়োগ ভাতার যে সীমা রয়েছে তার থেকে অবশ্যই কিছু বেশি বিনিয়োগ করে রাখবেন। এতে করে কর রেয়াত সুবিধার পুরোটাই ভোগ করতে পারবেন। মিজ নন্দিনী সারোয়ার যদি ৪,৬০,০০০ টাকার জায়গায় ৩,০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করতেন তাহলে কিন্তু তিনি এই ৩,০০,০০০ টাকার ওপর ৪৫,০০০ টাকা কর রেয়াত সুবিধা পেতেন। এতে করে তিনি কিছু কম কর রেয়াত সুবিধা পেতেন।
এবার মিজ নন্দিনী সারোয়ারের করদায় গণনা করে দেখাব ।
করযোগ্য আয় | করহার | করদায় (টাকা) |
প্রথম ৪,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ০% | – |
পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ৫% | ৫,০০০ |
পরবর্তী ৩,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ১০% | ৩০,০০০ |
পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ১৫% | ৬০,০০০ |
অবশিষ্ট ৪,৫৫,০০০ টাকা পর্যন্ত | ২০% | ৯১,০০০ |
মোট করদায় | ১,৮৬,০০০ | |
বাদ : কর রেয়াত | ৪৯,৬৫০ | |
নিট করদায় | ১,৩৬,৩৫০ |
তাহলে পেয়ে গেলাম মিজ নন্দিনী সারোয়ারের নিট করদায়। তিনি যখন রিটার্ন জমা দেবেন তখন ১,৩৬,৩৫০ টাকা চালানের মাধ্যমে জমা দিয়ে তার কপি রিটার্নের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেবেন।
চাকরি বা বাড়িভাড়া দিয়ে যেমন আয় হয়ে থাকে আবার তেমনি অনেকেই তাদের নিজ নিজ পেশা থেকেও আয় করে থাকেন। যেমন একজন শিক্ষক তার চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র পড়িয়েও আয় করে থাকেন। তখন তাদের আয় গণনা আবার ভিন্ন হবে। পরবর্তী পোস্টে এই নিয়ে বিশদ আলোচনা করবো।
Bangladesh Professionals VAT and Tax Law Firm