নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করলে কী হয়?

Income Tax Return
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হবে

৯.১ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করলে কী হয়?

কর দিবসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হলে গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হারে জরিমানা দিতে হবে। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপনার আয়কর রিটার্ন দাখিল করে বাড়তি জরিমানা পরিহার করার চেষ্টা করুন।

আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ বাতিল হয়ে এ বছর থেকে আয়কর আইন ২০২৩ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং এর ফলে ব্যক্তি করদাতার আয়কর গণনাসহ ট্যাক্স রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু পরিবর্তন এসেছে যা আগের অনুচ্ছেদগুলোতে জেনেছেন। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি করদাতা যদি কর দিবস অর্থাৎ ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হতেন তাহলে মাসিক ২% সুদ দিতে হতো। এই সুদ বকেয়া করের উপর গণনা করে রিটার্ন দাখিল করার সময় চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হতো।

কিন্তু আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী এই বছর থেকে ২% এর পরিবর্তে মাসিক ৪% করে সুদ দিতে হবে। এবং ৪% সুদ গণনা হবে মোট করদায়ের উপর। অর্থাৎ আপনি যদি কোনো অগ্রিম কর দিয়েও থাকেন বা উৎসে যদি কোনো কর প্রদান করা হয়েও থাকে তা বিবেচনা করা হবে না। তৃতীয় অধ্যায় থেকে জেনেছিলেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হলে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে না। আর এখন জানলেন মোট করদায়ের উপর মাসিক ৪% হিসেবে সুদ দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, কোন মাসের ভগ্নাংশও এক মাস হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন, কোন করদাতা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে পারেননি। পরে তিনি ডিসেম্বর মাসের ০৭ তারিখে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন তাহলে এক্ষেত্রে এক মাসের জন্য ৪% করে সুদ দিতে হবে।

আবার ধরুন, কোন করদাতা জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে রিটার্ন দাখিল করেছেন তাহলে দুই মাসের জন্য ৪% করে বকেয়া করের উপর সুদ দিতে হবে।

এখানে একটা প্রশ্ন করতে পারেন, পূর্বের আইন অনুযায়ী কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে না পারলে বর্ধিত সময়ের জন্য উপকর কমিশনারের কাছে আবেদন করতে হতো। এখনো কি আবেদন করতে হবে?

৯.৩ বিলম্ব সুদ কত দিতে হয়?

গত অনুচ্ছেদে জেনেছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হলে বড় ধনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অনুচ্ছেদ ৯.১-এ আরো জেনেছিলেন, বিলম্ব ফি দিতে হয় ৪% করে মাসিক ভিত্তিতে।

অনুচ্ছেদ ৫.২-এ আবদুল করিমের রিটার্ন ফরম পূরণ করেছি। পরিশিষ্ট-২-এ আপনি যে আবদুল করিমের রিটার্ন ফরম পূরণ দেখেছেন সেখানে তার নিট করদায় ছিল ৩৩,৩২০ টাকা। অর্থাৎ তার মোট করদায় ছিল ১,৭৪,২০০ টাকা। এ থেকে কর রেয়াত এবং উৎসে কর বাদ দেয়ার পর নিট করদায় ছিল ৩৩,৩২০ টাকা। এই টাকাই সরকার তার কাছে পাবে।

ধরে নিয়েছি, আবদুল করিম ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে পারেননি। তার কিছু দরকারি কাগজপত্র এখনো হাতে পাননি। পরে তিনি ২০ জানুয়ারি রিটার্ন দাখিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাহলে এখন তিনি কতো টাকা বিলম্ব সুদ দিবেন এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করার ফলে কি ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে তা দেখে নিন।

তিনি যেহেতু ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে পারেননি তাই ১,৭৪,২০০ টাকার উপরেই ৪% হিসেবে সুদ গণনা করতে হবে। তিনি যে কর রেয়াত পেয়েছেন তা বাতিল হয়ে যাবে এবং উৎসে যে কর দিয়েছেন তা বিলম্ব সুদ গণনার সময় বিবেচনা করা হবে না। যদিও তিনি জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে রিটার্ন দাখিল করছেন তারপরেও তাকে সম্পুর্ণ মাসের জন্য ৪% হিসেবে সুদ দিতে হবে ।

তাহলে দুই মাসের জন্য সুদ হবেঃ ১,৭৪,২০০×৪%×২ = ১৩,৯৩৬ টাকা I

করদাতা যখন ২০ জানুয়ারি তার রিটার্ন জমা দিবে তখন চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাঘারে জমা দিতে হবে ৯২,১৩৬ টাকা (১৭৪,২০০+১৩,৯৩৬-৯৬,০০০)। এখানে যে ৯৬,০০০ টাকা বাদ দিয়েছি তা হলো উৎসে কর । অর্থাৎ আপনি ৪% সুদ গণনার সময় উৎসে কর এবং অগ্রিম কর বিবেচনা না করে সুদ গণনা করবেন। কিন্তু প্রদেয় কর গণনার সময় তা বাদ দিবেন। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

এখানে লক্ষ্য করুন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করার কারনে একদিকে আবদুল করিম ৪৪,৮৮০ টাকা কর রেয়াত সুবিধা হারালেন এবং অন্যদিকে মোট করাদায় ১৭৪,২০০ টাকার উপর দুই মাসের জন্য ১৩,৯৩৬ টাকা বিলম্ব সুদ দিতে হলো। তাহলে তার মোট আর্থিক ক্ষতি হলো ৫৮,৮১৬ (৪৪, ৮৮০+১৩,৯৩৬) টাকা। তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে কর দিবসের পূর্বে আয়কর রিটার্ন দাখিল করুন। এতে করে জরিমানার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

৯.৫ একাধিক বছর রিটার্ন দাখিল করেননি, এখন কী করবেন?

বর্তমান আয়কর আইন অনুযায়ী আপনার যদি করযোগ্য আয় ৩৫০,০০০ টাকা অতিক্রম করে তাহলে আপনাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আয়কর বিবরণী জমা দিতে হবে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকল টিআইএনধারীকেই রিটার্ন দাখিল করতে হয়, তা আপনি ইতোমধ্যে জেনেছেন ।

আপনার করযোগ্য আয় ছিল তাই আপনি রিটার্ন দাখিল করেছিলেন। কিন্তু পরের অর্থবছরে আপনার করযোগ্য আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করেনি এবং সেজন্য আপনি হয়তো রিটার্ন দাখিল করা থেকে বিরত থেকেছেন। আবার, এমনও হতে পারে, আপনার করযোগ্য আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করেছে ঠিকই, কিন্তু আপনি টিআইএন নেননি এবং রিটার্নও দাখিল করেননি।

নিয়ম হলো, আপনি যদি একবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে রিটার্ন দাখিল করেন তাহলে পরপর তিনবার আপনার করযোগ্য আয় না থাকলেও আপনাকে রিটার্ন দাখিল করে যেতে হবে। আপনি যদি এই নিয়ম না মানেন তাহলেই আপনাকে আয়কর আইন ভাঙার দায়ে জরিমানার মধ্যে পড়তে হবে ।

এ অবস্থায় কোনো কারণে যদি আপনি কোনো বছরে বা একাধিক বছরে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করে থাকেন এবং এখন সেই বকেয়া আয় বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে চান, তাহলে কী করবেন?

প্রথম কথা হলো, আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে কোনো বাধা নেই। আপনি বকেয়া যে কোনো বছরের জন্য, তা একাধিক বছরের জন্য হলেও, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন ।

এখন আপনি যেহেতু আয়কর আইন মানেননি, তাই আপনাকে কিছু জরিমানা দিতে হবে রিটার্ন দাখিল করার সঙ্গে। সেই জরিমানাসহ রিটার্ন দাখিল করলেই আপনি আবার নিয়মিত হয়ে গেলেন ।

এখন প্রশ্ন হলো, এই জরিমানার পরিমাণ কত?

অনুচ্ছেদ ৯.১-এ রিটার্ন দাখিল না করলে জরিমানা কত দিতে হয় তা উল্লেখ করেছি । ওই মোতাবেক জরিমানা হিসাব করে আয়করসহ চালানের মাধ্যমে জমা দিয়ে রিটার্ন দাখিল করতে হবে।

বর্তমানে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার ফরম আগের চেয়ে অনেক সংক্ষিপ্ত এবং সহজ করা হয়েছে, যাতে করে করদাতা ভয় না পান। জটিলতা ছাড়াই যেন করদাতা তার রিটার্ন দাখিল করতে পারেন সেই চিন্তা মাথায় রেখেই প্রতিবছর আয়কর ফরম আগের থেকে সহজতর করা হচ্ছে। আপনি এখন কীভাবে আয়কর গণনা করে রিটার্ন ফরম তৈরি করতে হবে তা জানেন । তাই আপনি সবকিছু প্রস্তুত করে রিটার্ন দাখিল করুন।

 

মোহাম্মদ আদনান

আয়কর আইনজীবী

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড