সরকারি চাকরিজীবীর আয় কি করের আওতামুক্ত? | Professionals TaxVAT
সরকারি চাকরিজীবীর আয় সম্পূর্ণ করের আওতামুক্ত নয়, তবে বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা ইত্যাদি করমুক্ত থাকবে, অর্থাৎ কর দিতে হবে না । তাহলে বুঝতেই পারছেন, আপনি সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী করদাতার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। অনেক কম কর দিতে হচ্ছে।
সরকারি আদেশভুক্ত কর্মচারী কারা তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত আদেশে বলা হয়েছে। আর তাদের আয়কর কীভাবে গণনা করতে হবে তা ১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে এস.আর.ও নং ২২৫-আইন/আয়কর-০৭/২০২৩-এ উল্লেখ রয়েছে।
এই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, একজন সরকারি চাকরিজীবী করদাতার বেতন খাত থেকে প্রথমে মোট করদায়, তারপর বিনিয়োগ ভাতার ওপর প্রাপ্য কর রেয়াত বাদ দিয়ে করদায় বের করব ।
ওপরে উল্লিখিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সরকারি বেতন আদেশভুক্ত একজন কর্মচারীর সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মূল বেতন, উৎসব ভাতা ও বোনাস (যে নামেই অভিহিত হোক না কেন) করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
কর কম দেয়ার পাশাপাশি আরেকটি বড় সুবিধা হলো, একজন সরকারি চাকরিজীবী করদাতার মোট আয় থেকে করযোগ্য আয় বের করা অনেক সহজ এবং অল্প সময়ের মধ্যেই করা যায়। একজন বেসরকারি চাকরিজীবী করদাতার মোট আয় থেকে করযোগ্য আয় গণনা অনেকটা জটিল ।
তবে করযোগ্য আয় গণনা-পরবর্তী কাজগুলো আবার একই রকম। তাহলে চলুন এবার সরাসরি উদাহরণে চলে যাই। ধরে নিলাম, মিস্টার অলিউর রহমান উত্তরায় থেকে সরকারি চাকরি করেন এবং সারাবছরে নিম্নোক্ত হারে বেতনভাতাদি পেয়েছেন :
০১. মাসিক মূল বেতন ৩৫,৫০০ টাকা
০২. মাসিক বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৪০% অর্থাৎ ১৪,২০০ টাকা
০৩. মাসিক চিকিৎসা ভাতা ৭০০ টাকা
০৪. উৎসব ভাতা ৭১,০০০ টাকা (বাৎসরিক)
০৫. বাংলা নববর্ষ ভাতা ৭,১০০ টাকা
ভবিষ্য তহবিলে তিনি প্রতিমাসে ৩,৫০০ টাকা জমা রাখেন । এর বাইরে তার নামে ডিপিএস আছে মাসিক ৫,০০০ টাকা এবং বছরে জীবন বীমা প্রিমিয়াম দিয়েছেন ৫০,০০০ টাকা ।একে একে জেনে নিলাম মিস্টার অলিউর রহমানের বেতন থেকে আয়গুলো এবং পাশাপাশি তিনি সারাবছর ধরে যে বিনিয়োগ করেছেন সেসব তথ্য। এবার ধাপে ধাপে তার করযোগ্য আয়, কর রেয়াত এবং করদায় নির্ণয় করব।
মোট করযোগ্য আয়
আপনি শুরুতেই জেনেছেন, প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী শুধু মূল বেতন, উৎসব ভাতা এবং বোনাস করযোগ্য আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। বাকি সব করমুক্ত। অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ওপরে মিস্টার রহমানের যে উদাহরণ দিয়েছি সেখানে মাসিক ভিত্তিতে তিনি কত বেতন পান তা উল্লেখ রয়েছে। এর সঙ্গে কিছু তথ্য রয়েছে বাৎসরিক ভিত্তিতে। যেহেতু সারাবছরের আয় হিসাব করছি তাই যে আয়গুলো মাসিক রয়েছে তাকে ১২ মাস দিয়ে গুণ করে বাৎসরিক করে নেব।
সরাসরি নিচের টেবিলে মিস্টার রহমানের বেতন খাতে আয় থেকে অব্যাহতি বাদ দিতে করযোগ্য আয় বের করব।
ক্র. নং | বেতন খাত | আয় | অব্যাহতি | করযোগ্য আয় |
০১ | মূল বেতন (৩৫,৫00 x ১২ ) | ৪,২৬,০০০ | – | ৪,২৬,০০০ |
০২ | বাড়িভাড়া (১৪, ২০০ x ১২) | ১,৭০,৪০০ | ১,৭০,৪০০ | – |
০৩ | চিকিৎসা ভাতা (৭০০ x ১২) | ৮,৪০০ | ৮,৪০০ | – |
০৪ | উৎসব ভাতা | ৭১,০০০ | – | ৭১,০০০ |
০৫ | বাংলা নববর্ষ ভাতা | ৭,১০০ | ৭,১০০ | – |
মোট | ৬,৮২,৯০০ | ১,৮৫,৯০০ | ৪,৯৭,০০০ |
ওপরের টেবিলে খুব সহজে মিস্টার রহমানের বেতন খাতে মোট আয় থেকে অব্যাহতি বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় ৪,৯৭,০০০ টাকা পেয়ে গেছি। আশা করছি, আপনিও আপনার করযোগ্য আয় পেয়ে গেছেন।
শুধু মনে রাখবেন, তিনটি বিষয় – মূল বেতন, উৎসব ভাতা এবং বোনাস। এই তিনটি আয়ই আপনার করযোগ্য আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। বেতন খাতে আপনি বাকি যা-ই পাবেন তার সবই করমুক্ত। আপনি ওপরের টেবিলে নিয়ে আসবেন; কিন্তু অব্যাহতির ঘরে লিখে মোট করযোগ্য ঘর ফাঁকা রাখবেন। এইভাবে আপনি যদি আপনার মোট আয় থেকে করযোগ্য আয় বের করেন তাহলে আপনার কাছে খুবই সহজ মনে হবে।
যেহেতু করযোগ্য আয় পেয়ে গেছি তাই এবার বিনিয়োগ ভাতা বের করে কর রেয়াত নির্ণয় করব।
বিনিয়োগ ভাতা এবং কর রেয়াত
আপনি জানেন যে, করযোগ্য আয়ের ৩% কর রেয়াত হিসেবে দাবি করা যায় । তাহলে মিস্টার রহমানের করযোগ্য আয় ৪,৯৭,০০০ টাকার ৩% হিসেবে কর রেয়াত হবে ১৪,৯১০ টাকা। এবার দেখতে হবে তিনি প্রকৃতপক্ষে কত বিনিয়োগ করেছেন এবং তার উপর তিনি কতো কর রেয়াত পাবেন ।
ক্র. নং | বিনিয়োগ খাত | টাকা |
০১ | ভবিষ্য তহবিল (৩৫,০০x১২) | ৪২,০০০ |
০২ | ডিপিএস (৫,০০০ x ১২) | ৬০,০০০ |
০৩ | জীবন বীমা প্রিমিয়াম | ৫০,০০০ |
মোট প্রকৃত বিনিয়োগ | ১,৫২,০০০ |
ওপরের টেবিল থেকে দেখতে পাচ্ছি মিস্টার রহমান বিনিয়োগ করেছেন ১,৫২,০০০ টাকা ৷ এই টাকার উপর ১৫% হিসেবে কর রেয়াত হবে ২২,৮০০ টাকা। কিন্তু তিনি কর রেয়াত সুবিধা পাবেন ১৪,৯১০ টাকা।
যেটা আগের লেখায় বলেছিলাম, আপনার বিনিয়োগ ভাতার যে সীমা রয়েছে তার থেকে অবশ্যই কিছু বেশি বিনিয়োগ করে রাখবেন। এতে কর রেয়াত সুবিধার পুরোটাই ভোগ করা যাবে । মিস্টার রহমান যদি ১,৫২,০০০ টাকার জায়গায় ৯০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করতেন তাহলে কিন্তু তিনি এই ৯০,০০০ টাকার ওপরই কর রেয়াত সুবিধা পেতেন ১৩,৫০০ টাকা । এতে করে তিনি ১৪,৯১০ টাকার স্থানে কিছু কম কর রেয়াত সুবিধা পেতেন। তাই সব সময় কিছু বেশি করে বিনিয়োগ করে রাখবেন। এতে করে আপনারই সুবিধা হবে।
তাহলে কর রেয়াত পেয়ে গেলাম। এবার মিস্টার রহমানের করদায় নিচের টেবিলে গণনা করে দেখাব ।
করযোগ্য আয় | করহার | করদায় (টাকা) |
প্রথম ৩,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ০% | – |
পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত | ৫% | ৫,০০০ |
অবশিষ্ট ৪৭,০০০ টাকা পর্যন্ত | ১০% | ৪,৭০০ |
মোট করদায় | ৯,৭০০ | |
বাদ : কর রেয়াত | ১৪,৯১০ | |
নিট করদায় | (৫,২১০ ) |
তাহলে পেয়ে গেলাম মিস্টার রহমানের নিট করদায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কর রেয়াত বাদ দেয়ার পর নিট করদায় ঋণাত্মক ৫,২১০ টাকা ।
তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, মিস্টার রহমান কত টাকা কর দেবেন? তাকে কি আদৌ কোনো কর দিতে হবে? নাকি শুধু রিটার্ন দাখিল করলেই চলবে?
এর উত্তর হলো, কর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম কর দিতে হবে। মিস্টার রহমান যেহেতু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকেন তাই তার ন্যূনতম কর হবে ৫,০০০ টাকা। তিনি যখন রিটার্ন দাখিল করবেন তখন চালান করে তার কপি রিটার্নের সঙ্গে জমা দিলেই হবে ।
কারণ, যদি কোনো করদাতার করযোগ্য আয় করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করে তাহলে তার কর ন্যূনতম করের চেয়ে কম বা ঋণাত্মক হলেও তাকে তার অবস্থানভেদে ন্যূনতম কর দিতে হবে।
আপনি যে এলাকায় থাকেন সেই এলাকার জন্য ন্যূনতম কর কত তা দেখে নিন এখানে ।
আর যদি ন্যূনতম করের চেয়ে বেশি আসে তাহলে যে কর আসবে আপনি তাই জমা দেবেন। যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, করদায় ন্যূনতম করের চেয়ে কম আসতে বা ঋণাত্মক হতে। এর কারণ হলো, যেহেতু সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন খাতের বেশির ভাগ আয়ই করমুক্ত তাই তাদের আয়ের বড় অংশই করযোগ্য আয়ের বাইরে থাকে। যার ফলে তাদের কর কম আসে।
চাকরির পাশাপাশি কারো হয়তো বাড়ি আছে বা ফ্ল্যাট আছে বা কিনেছেন এবং সেই বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েও আয় আসে। বাড়ি ভাড়া দিয়ে যে আয় হয় তাও আয়ের সঙ্গে যোগ করে কর গণনা করতে হয় ৷ আগের লেখায় এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, চাইলে নিচের দেওয়া লিংকে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন।
💠 বাড়িওয়ালার আয় কত হলে ট্যাক্স দিবেন…
Bangladesh Professionals VAT and Tax Law Firm